নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) গঠিত হয়েছে বেশিদিন হয়নি। এখনো দলটি ঠিকঠাক গুছিয়ে উঠেছে তাও বলা যাচ্ছে না। এরই মধ্যে তাদের নিতে হচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি। একদিকে নির্বাচন অন্যদিকে দল গোছানোর কাজ- কোনটাকে প্রাধান্য দেবে দলটি তা নিয়ে চলছে আলোচনা। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্বদানকারীদের এ দলটিকে আপাতত সাংগঠনিক কাঠামো, শৃঙ্খলা ও গঠনতন্ত্র প্রণয়নের মতো মৌলিক কাজেই বেশি মনোযোগ দিতে হচ্ছে।
এ বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর মানিক মিয়া অ্যাভিনিউতে সমাবেশের মাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করে জাতীয় নাগরিক পার্টি- এনসিপি। সেদিন দলটির একটি আংশিক কমিটি ঘোষণা করা হয় এবং পরে ২১৭ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটির অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর থেকে সাংগঠনিক কার্যক্রমের পাশাপাশি দলটির নেতারা বিভিন্ন রাজনৈতিক ইস্যুতে আলাদা আলাদাভাবে সক্রিয় হন।
রাজনৈতিক দল হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকে অবশ্য নানা কারণে আলোচনা-সমালোচনার মধ্যে আছে এনসিপি। দলটির কেন্দ্রীয় নেতাদের বিলাসবহুল জীবনযাপন, জনসংযোগে বিশাল গাড়িবহর, তদবির বাণিজ্য, জেলায় জেলায় নেতাকর্মীদের মাঝে হট্টগোল ও হাতাহাতি নিয়ে নানা নেতিবাচক খবর ও গুজব দুটোই ছড়িয়েছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নেতাদের বিতর্কিত স্ট্যাটাসও বিব্রতকর পরিস্থিতি তৈরি করেছে।
এসবের মাঝেও দল গোছানো এবং জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি দুটো কাজই চালিয়ে যাচ্ছে এনসিপি। তবে আপাতত দল গোছানোর বিষয়টি গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি।
এনসিপির একাধিক নেতা জানিয়েছেন, আপাতত দল গোছানোর দিকেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছেন তারা। এরই মধ্যে দক্ষিণাঞ্চলের কয়েকটি জেলার কমিটি গঠনের জন্য সাংগঠনিক টিম গঠন করা হয়েছে। নেতাদের আসনভিত্তিক প্রচার থেকে বিরত থাকার নির্দেশনা দিয়ে জেলা ও তৃণমূল পর্যায়ে সাংগঠনিক কার্যক্রমে সক্রিয় থাকতে বলা হয়েছে।
এনসিপির যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার বলেন, ‘নতুন দল হলে পূর্ণাঙ্গ কমিটি, গঠনতন্ত্র, নিবন্ধনের আবেদন- এসব নিয়মিত কাজ। এগুলো এক দিনে হয় না। আমরা এসব নিশ্চিত করছি। এগুলোর মাধ্যমেই নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। এটা একই কাজের দুই দিক। আমরা দল গোছানোর দিকেই বেশি ফোকাস দিচ্ছি। কাউকে বলা হয়নি আপনি কোন আসনে নির্বাচন করবেন। বরং সবাইকে জেলা ভিত্তিক সাংগঠনিক কাজ করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।’
জানা গেছে, দল গঠনের পর থেকে এখন পর্যন্ত চারটি সাধারণ সভা করেছে এনসিপি। এসব সভায় দলের বিভিন্ন সমস্যা নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা হয়েছে। কোন কোন বিষয় এনসিপিকে বিব্রতকর পরিস্থিতিতে ফেলেছে এবং কারা এর জন্য দায়ী, সে সম্পর্কে খোলামেলা আলোচনা হয়েছে।
দলের ভেতরে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কঠোর অবস্থান নিয়েছে এনসিপি। শিগগিরই একটি পূর্ণাঙ্গ শৃঙ্খলাবিধি প্রণয়ন করা হচ্ছে। একই সঙ্গে বক্তব্য, বিবৃতি এবং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে স্ট্যাটাস নিয়েও দেওয়া হয়েছে সতর্কবার্তা
সভাগুলোতে কোন নেতা কীভাবে বড় শোডাউন করে প্রচারণা চালাচ্ছেন, কারা তদবির বাণিজ্যে জড়িত- এসব বিষয় উঠে এসেছে। কিছু নেতাকে সতর্ক করা হয়েছে, আবার কাউকে সাময়িক অব্যাহতি দিয়ে কারণ দর্শানোর নোটিশ দেওয়া হয়েছে।
এনসিপির একাধিক নেতা বলেন, দলের যেকোনো সমস্যাকে গুরুত্ব দিয়েই সাধারণ সভায় এজেন্ডা হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। সাম্প্রতিক চারটি সভায় অনেক ছোটখাটো বিষয়ও আলোচনায় এসেছে। দলের নাম ভাঙিয়ে কেউ যদি অপকর্মে জড়ায় তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সম্প্রতি দলের যুগ্ম সদস্যসচিব গাজী সালাউদ্দিন তানভীরকে সাময়িকভাবে বহিষ্কার করা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে জেলা প্রশাসক নিয়োগে অবৈধ হস্তক্ষেপ এবং জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ডের ছাপার কাগজ সরবরাহে কমিশন বাণিজ্যে জড়িত থাকার অভিযোগ ওঠে।
অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা বজায় রাখা এবং সদস্যদের বিরুদ্ধে উত্থাপিত শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগ তদন্তের জন্য ১২ সদস্যের একটি ‘শৃঙ্খলা কমিটি’ গঠন করেছে দলটি। এ কমিটির প্রধান করা হয়েছে দলের এক নম্বর যুগ্ম সদস্য সচিব আব্দুল্লাহ আল আমিনকে। এছাড়া কেন্দ্রীয় নেতাদের কার্যক্রম ও তৃণমূলে দেখা দেওয়া বিশৃঙ্খলা মোকাবিলায় একাধিক কমিটি গঠন করা হয়েছে। কেউ যেন দলের নাম ভাঙিয়ে অপকর্ম করতে না পারে সেজন্য সবাইকে জবাবদিহিতার মধ্যে রাখা হবে- এমন সিদ্ধান্ত হয়েছে দলীয়ভাবে।
জাতীয় নাগরিক পার্টির কেন্দ্রীয় যুগ্ম সদস্য সচিব এস এম সুজা উদ্দিন বলেন, ‘বর্তমানে বাংলাদেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো সংস্কার এবং আওয়ামী লীগের বিচার। এটিই আমাদের প্রধান এজেন্ডা। আমরা চাই সারা দেশের প্রতিটি মানুষ, বিশেষ করে যারা জুলাই সংগ্রামে অংশ নিয়েছেন তারা আমাদের সঙ্গে যুক্ত হোন।’
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের অসংখ্য মানুষের রাজনীতিতে আগ্রহ রয়েছে। নির্বাচন বাংলাদেশের মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার। সেই অধিকার প্রাপ্তির ক্ষেত্র যেন তৈরি হয়, নির্বাচনের মাঠে যেন লেভেল প্লেয়িং নিশ্চিত হয় সেদিকেও আমরা খুব কাছ থেকে নজর রাখছি।’
সাংগঠনিক কার্যক্রমে গতিশীলতা আনতে একটি ‘পলিটিক্যাল কাউন্সিল’ গঠনের সিদ্ধান্ত নিয়েছে এনসিপি। এ কাউন্সিল সংগঠনের নীতি-নির্ধারণী সর্বোচ্চ ফোরাম হিসেবে কাজ করবে। এছাড়া এই কাউন্সিলের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে একটি ‘নির্বাহী কাউন্সিল’ গঠনেরও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। তিন মাস অন্তর এই নির্বাহী কমিটি পুনর্মূল্যায়ন, প্রয়োজনে নবায়ন করা হবে।
এছাড়া দলের গঠনতন্ত্র প্রণয়নের লক্ষ্যে পাঁচ বা ততোধিক সদস্যের একটি ‘গঠনতন্ত্র প্রণয়ন টিম’ গঠনের সিদ্ধান্ত সাধারণ সভায় গৃহীত হয়েছে। এই টিমকে খসড়া গঠনতন্ত্র প্রস্তুত করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের যোদ্ধাদের আইনি সহায়তা প্রদান, আন্দোলন সংগঠনে ভূমিকা রাখা এবং ন্যায়বিচারের পক্ষে রাজপথে সক্রিয় ভূমিকা রাখা আইনজীবীদের সংগঠিত করতে ‘এনসিপি আইনজীবী উইং’ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি।
এছাড়া জুলাই অভ্যুত্থানে অসামান্য অবদান রাখা প্রবাসী বাংলাদেশিদের রাষ্ট্র পুনর্গঠনের কাজে যুক্ত করতে ‘এনসিপি ডায়াস্পোরা অ্যালায়েন্স’ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছে জাতীয় নাগরিক পার্টি। দলটি জানিয়েছে, এই অ্যালায়েন্স একটি স্বাধীন ও স্বতন্ত্র গঠনতন্ত্র অনুযায়ী পরিচালিত হবে এবং দেশীয় ও আন্তর্জাতিক আইনি কাঠামোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে কাজ করবে।
এনসিপি সূত্রে জানা গেছে, দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায় সংগঠন বিস্তারে একটি সাংগঠনিক টিম গঠন করা হয়েছে। এই অঞ্চলের আওতায় রয়েছে পার্বত্য চট্টগ্রাম, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, কুমিল্লা, বরিশাল, কুষ্টিয়া, খুলনা, ফরিদপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকা দক্ষিণ (মহানগর ও জেলা)। এসব এলাকায় দলীয় কমিটি অনুমোদন দেওয়া হয়েছে।
উল্লেখ্য, গত ৪ মার্চ আনুষ্ঠানিকভাবে দলের কার্যক্রম শুরু করে এনসিপি। প্রথম সাধারণ সভা অনুষ্ঠিত হয় গত ৭ মার্চ। সভা শেষে দলের আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম জানিয়েছিলেন, তারা এখন দলের নিবন্ধনের শর্ত পূরণে মনোযোগী হচ্ছেন।
আপনার মতামত লিখুন :